Thursday, March 10, 2016
সম্ভাবনার কোনো কোনো ছায়া
জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছি। সকাল। সময় বন্ধ,
কটা বাজে জানি না। উল্টোদিকের একটা জানলায় আর একজন ধীমান আমায় দেখছে। আমিও ওকে
দেখি। সেই জন্ম থেকে। হয়তো জন্মের আগে থেকে। না চিনলেও কয়েক টুকরো ভাঙা ধীমানের
সাথে সারাজীবন কাটানো।
এই অন্য ধীমান তো আমারই ছায়া। অথবা আমি সেই
অন্য ধীমানের ছায়া। মনে হয় ও কি আমারই মতন ভাবে! আমার কথা? ওই ছায়াই ইদানীং আমাকে
দিয়ে অনেক কবিতা লিখিয়ে নিচ্ছে। তবুও কখনো কখনো মনে হয় – কেউ হাতছানি দিয়ে ডাকলেও
আমি ওই ছায়ার ভিতর আর যাবো না। আমাকে আমি যখন একটা ভালোবাসার চিঠি লিখি তখন,
ডাকবাক্স খুলে আলোরা বেরিয়ে, পেখম তুলে নাচে আমার ছায়ার চারপাশে। অন্য ধীমানের
চারপাশে। কিছু কিছু কবিতা আজকাল আমার কাছে এরকমই।
গুহায় ঢুকে অল্প সময় অনেক সময় কাটিয়েছি,
কিন্তু সারারাত থাকিনি কখনও। গুহার অন্ধকারে আমার ছায়া আমাকে ঠিক খুঁজে বার করেছে।
কখনো কখনো ভালোবেসে ছায়াকে আমি চুমু খেয়েছি। যেভাবে আমার কবিতাকে। গুহার ভিতর
সবসময় আলো। যেরকম আমার ভেতর, আমার কবিতার ভেতর সবসময় আলো। টের পাই। পৃথিবী বলতে তো
ওটুকুই। কখনো বা একটু ঝুঁকে একটু ভালোবেসে পরম মমতায়, গুহার মজলিস,
অ্যান্টিসেপটিক, জলযান, মেটফরমিন বা আবর্জনা থেকে কুড়িয়ে তুলি আমার অর্ধেক পৃথিবী।
ঘুমে ঢলে পড়া ছায়া। আর অন্য ধীমানের ছায়া তখন কবিতা লেখে।
চারপাশে এত সুন্দর কিসের? নিরাময় তাকে
ফিসফিস করে ডেকে এনেছে, হতে পারে। সেই ছোটবেলা থেকে আমি তো কোনোদিন আতর মাখিনি।
কেউ কেউ ভালোবাসবে বলে খুলে রাখে সরাইখানা, বৃন্দগান, নিরীহ মেঘ। জানলার বাইরে
মাঝে মাঝে সাবমেরিন চড়ে ভুস করে জেগে ওঠে আমার ছায়া। ওই জল জানতো কোথায় আমার ঘরবাড়ি, উৎসবের শনি ও
রবিবারগুলো। একদিন দেখি এরোপ্লেন থেকে প্যারাসুট খুলে নেমে এসেছে সে। কবিতা কি
তাহলে এভাবেই নামে? কবিতা লেখার সময় আমার অর্ধেক চড়ে বসে আলো আলো চশমায়। জলের
দু’চারটে শরীর হয়ে হেঁটে যায় টিয়াপাখির সবুজ ফ্রক।
সারা জীবন কেউ না চিনলেও, এক-আধজন মানুষের
তাতে কিছু এসে যায় না। তারা কেউ ফুলপ্যান্ট পরে, কেউ কাঞ্জিভরম। চোখে চশমা হয়তো
নাও থাকতে পারে। থাকলেই বা কি! তবে আমার ছায়া থুড়ি কবিতার কাঁধে বহুসময়ই একটা
ব্যাগ থাকে। কেউ বেহালা বাজালে বা কবিতা পড়লে, সে চুপচাপ তার পাশে বসে থাকে। সুর
বা একটি কবিতা তার মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা আমার ছায়াকে একটি নতুন কবিতা
লিখতে সাহায্য করে। সবসময় যে করেই তা নয়, কিন্তু বহুসময়ই। বেহালা বাজাতে না
জানলেও, একদিন তা বাজিয়ে দেখবো আমি।
সারাজীবন যাদের কেউ চিনলো না, তারা কি নিজের
ছায়া দেখে ভয় পায়? তারা কি ছায়াকে মৃত্যু বলে ভাবে? কিন্তু সারা পৃথিবীতেই তো
মুখময় অপেরা নিয়ে ছায়ালাগা জল গোল হয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। ছায়া তো মৃত্যু নয়। আমি,
অন্য ধীমান বহুবার একে অপরের দিকে গড়িয়ে দিয়েছি আমাদের ভুতুড়ে ছায়া। আর ওই গড়ানো
গতি বারংবার নিয়ে গেছে আলোর ঠিকানায়, অন্ধকারের নোটেশনে। মন খারাপের ফাল্গুন ভুলে
সেখানেই তো কবিতার কাচের জানলা। যার অন্যপাশ কখনো আবছা বা কুয়াশাময়। কখনো লাবণ্যর
নখরঞ্জনী।
কবিতায় কবি নিজেই নিজেকে দেখাতে চান বিভিন্ন
কোণ থেকে। এই জার্নি তাকে এক অপার রহস্যের ভিতর দিয়ে নিয়ে যেতে যেতে পৌঁছে দিতে
চায় বিদিশায়। কবিতায় একই সাথে উপস্থিত হয়, খেলে বেড়ায়—আলো এবং অন্ধকার। কখনো অঝোর
বৃষ্টি তো কখনো প্যারামবুলেটর। জীবনের ভাঙা টুকরোর পাশাপাশি প্রজাপতির দীর্ঘ
ফাল্গুন। নিজেই নিজের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে এই যে দেখতে চাওয়ার ঐকান্তিক
প্রচেষ্টা, তা খুবই উপভোগ্য। নিজেই নিজের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে দেখার সেই আনন্দ আর
মজা আমার অনুভূতিতে প্রশ্রয় দেয় রূপটানের লাবণ্য, ছুমন্তর লেগে থাকা হাসাহাসি।
সাবানের গন্ধ লাগা অদেখা স্বপ্ন তার সম্ভাবনা নিয়ে খুলে দেয় ওভারকোট পরে আসা
অন্ধকারের সমস্ত দরজা। আর দরজার ওপাশেই তো নাচতে নাচতে ক্রমাগত চলে যেতে থাকে
অফুরন্ত আলোর মার্বেল।
তো সেই সম্ভাবনাকে সারারাত সারাদিন অনুসরণ
করে আসতে থাকে আমাদের ছায়া ও ছায়ার আবহাওয়া, যা ভোর পর্যন্ত চুপচাপ ঘুমিয়ে তোমাদের
দু’পাশে। ঘুমের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে আমি আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করি নিজেরই চেতনা। যে
চেতনা আমায় চালিয়ে নিয়ে এল এতদূর। মাঝে মাঝে মনে হয়, সত্যিই কি আমি এসেছি কিছুটা—যাকে
এতদূর বলে মনে হয় বারবার। নাকী এ এক ভ্রম, দাঁড়িয়ে আছি একই স্থানে। যেখানে কারোর
চোখের কাজল রঙ করে দিল মাকড়সার জাল, এক-আধটা শীত বিয়ে করে প্রিয় ইস্কুলকে। বুঝতে
পারি অনুভব করতে পারি, নিজেই নিজের থেকে বেরিয়ে না এলে কবিতা হওয়ার নয়। এই
সম্ভাবনাই আমার মুঠো মুঠো। ওষুধ আর ইনস্যুলিন সিরিঞ্জকে পাশে সরিয়ে রেখে বেরিয়ে
আসতে বলে স্বপ্নের বাইরে ক্রমাগত বেজে চলা আলোর চাকতিতে, রাস্তাবাড়ির আধো
অন্ধকারের হাততালিতে। সেই তো ওল্টানো চেয়ার সোজা করে কখনো বসতে বলে। হাত মিলিয়ে
দেয় কবিতার সাথে।
প্রাণ আছে সবকিছুতে।
ওই পায়রার ডানায় কিংবা কাচের গ্লাসে। ওইদিকে তাকিয়েই তো লুকিয়ে ফেলতে চেয়েছিলাম
যাবতীয় অজ্ঞতা। প্রাণ আছে বলেই কখনো কমলালেবু গড়াতে গড়াতে ফুটবল হয়, তারপর পৃথিবী।
টেবলে রাখা স্তুপাকৃত বই কতবার যে আফ্রিকান লোকসংগীত শুনিয়েছে, তা আর মনে করতে
পারি না। ডালিম গাছ লতপত করে বেড়ে উঠেছে বিচারকের সাদা পরচুলায়। জড় বস্তুর প্রাণ
আছে বলেই তো আমার কবিতায় সবকিছু নড়েচড়ে বেড়ায়, এতটা সজীব। রাত্রিবেলা দূর
বারান্দায় বসে চুপচাপ দেখি আমার কবিতার ঘাসে ঘাসে নেচে যায় যাদুকরের ফেলে যাওয়া
নাইটল্যাম্প, কয়েক কণা দিগন্ত। সেখানে কি তবে কিছুটা সময় ও পরিসর ধরা পড়লো? আমার
ছায়ার সাথে হেঁটে হেঁটে এই বহুদূর এসে ওরাও তো আমাকে দেখছে। হয়তো বিপ্রতীপে। অথবা
জলের অতল থেকে।
আজকাল মনে হয় আমার চেতনা যেভাবে কবিতাকে
উপস্থাপিত করে, করতে চায়; সেই একইভাবে সময় ও পরিসর, বিশেষত পরিসর তার কামারশালায়
আমাকে নির্মাণ করে চলেছে। সেখানে পাশাপাশি ক্ষয় ও পরিপূর্ণতা। কিন্তু পরিপূর্ণতা
তো হওয়ার নয়। কারণ কোনও কিছুই সম্পূর্ণ বলে আমি বিশ্বাস করি না। মানুষ বা প্রকৃতি—এসব
সম্পূর্ণভাবে কখনোই আমার কবিতায় স্থান করে নিতে পারে না। তাই ও আমায় দেখে আর আমি
ওকে দেখি। আমি আর আমার ছায়া—দুজন নিজের নিজের মনে, চেতনায়, সম্ভাবনায় সম্পূর্ণ হয়ে
ওঠার চেষ্টা করি। ওসবের প্রতিধ্বনি এক নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে, এই ক্রমাগত
জার্নিতে আমার হয়তোবা আমাদের পাশাপাশি হেঁটে চলে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
পৃথিবী বলতে তো ওটুকুই…সমৃদ্ধ হলাম!
ReplyDelete