দোলনচাঁপা চক্রবর্তী
দেবাঞ্জন দাসের বিল্লিবাদল — যে কথা হয় হসন্তে
দেবাঞ্জনের কবিতা পাঠ আমি প্রথম শুনি নতুন কবিতার সম্পাদক রঞ্জন মৈত্রের
বাড়িতে। প্রায় ছয় বছর আগে। ব্যক্তিগত ভাবে কবিতার সশব্দ পাঠে আমার চিরকালীন কিছু
অসুবিধা আছে, বিশেষত যদি তা আবৃত্তিযোগ্য কবিতার বিপরীত ঘরানার হয়। কারুর পাঠের
মধ্যে দিয়ে তার কবিতাকে আমি কখনো স্পর্শ করতে পারিনি, আমার ব্যক্তিগত এবং নিঃশব্দ পাঠের
প্রয়োজন। অথচ এখন এই বইটা পড়তে গিয়ে দেখছি যে ছয় বছর আগের সেই পাঠে আমার প্রথম
শোনা কবিতা ‘মনা বেড়াল-১’-এর মনস্তাত্বিক অভিব্যক্তি আমার হুবহু মনে পড়ে
যাচ্ছে। সেই সঘন বৈশাখী বিকেলের দিকে গড়িয়ে যাওয়া এক তন্দ্রাচ্ছন্নতা, বিড়ালের
থাবার অনুকূলে এক মনোরম বনেদিয়ানা। কবিতার কিছু প্রিয় অংশ পড়া যাক-
ফাটা বাঁশ থেকে
যে পিদিম একান্নবর্তী
তার দিব্যি
রাতবিরেতে আমি একলা হাঁটি
বেদানা হই মাঠে-ঘাটে
আর ঠুনঠুন করে যে বর্ষা ঝরলো
তার অঝোর আমাকে চিমটি কাটে
আমি স্মিত হই
পিং পং-এ হেলান দিয়ে দেখি
বিকেলের মল্লারে নোকরি করছেন
বাবা তানসেন
‘নোকরি’
এবং ‘বাবা’ শব্দের ঝলক লক্ষ্যণীয় এবং হতবাক করে দ্যায়! দেবাঞ্জনের কবিতার সমগ্রতা
জুড়ে এই মধ্যবিত্ত, নস্টালজিক বনেদিয়ানা বৃত্ত কেটেছে। অথচ কোথাও স্মৃতিবিলাসিতা
নেই, জোলো ঝিলমিল ন্যাকামি নেই। এই অপূর্ব বৈসাদৃশ্য একটা অনুরণন তোলে। গভীর
উপত্যকার এপাশে দাঁড়িয়ে দূরে ওইদিকে পাহাড়ের বুকে ভূকম্পনের যে মুদ্রা, সেরকম
নিশ্ছিদ্র অনুরণন, যেমন এই কবিতাটা...
এলোখানি তার ঘর জুড়ে
ভুরু পাখোয়াজ
ঝপ করে যখন সন্ধ্যা মাড়ালো
তখন খালি সইলো আর সইলো
বল তো হারিকিরি এঁকে দেব চাঁদে
মনা বেড়ালের ছায়াকে
সোনা বলব
বলব তোর্সা
মনা বেড়াল-২
বিড়ালের
ব্যবহার সাহিত্যে বা সিনেমায় নতুন নয়। কিন্তু নিজের একান্ত ইচ্ছের দিকচিহ্নগুলোকে
কবিতায় রসবোধের মধ্যে দিয়ে প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিড়াল ব্যবহারের অভিনবত্ব প্রশংসনীয়।
এই পংক্তিগুলো পড়িঃ
যেন আলগোছের আল্লারাখা চলেছেন
গিমি গিমি সুর্মা
আর অন্তিমে বিসর্গ সরানোর খেলা
অবশেষে দেখা যাবে
কলিমে ফুটবেন বলে
বসে আছেন
মনা বেড়াল
-
মনা বেড়াল-৩
আন্তর্জাতিক সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত বেড়াল
বেহেমট। তার অবশ্য দাবা, ভদকা এবং পিস্তলে আগ্রহ ছিল, এবং ছিল ব্যাঙ্গাত্মক জবান।
তার প্রতীকের জায়গাটা প্রতিফলিত হয়েছে তুখোড় গদ্যের ভাষ্যে এবং তা পুরোপুরি আলাদাও
বটে। সে তুলনায় মনা নেহাতই নিরীহ। কিন্তু তার ‘দাঁতের বাহার সরোদ শেখায়’,
যদিও ‘ডেকে ওঠার মতো কোনো ডাকটিকিট’ নেই ’; তবুও ‘হতে পারত অনেক কিছুই/
কুয়াশার মেহেরুন্নিসা/ বা নিয়ত মেঁহেদীবাগান’। কবিতায় বিড়াল ব্যবহারের প্রভাব
প্রসঙ্গে মনে পড়ছে গত শতকের জাপানি কবি সাকুতারো হাজিওয়ারা-র ‘বিড়াল শহর’
কাব্যগ্রন্থের কথা। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের উন্মাদ সময়ে ১৯২৬-এ প্রকাশ
পায় এই বইটি। বৌদ্ধধর্ম এবং শোপেনহাওয়ারের নাস্তিক্যবাদের ধারণাভিত্তিক তাঁর ‘নীল
বিড়াল’ কাব্যগ্রন্থের (১৯২৩) কবিতাগুলিকে সম্পূর্ণটাই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল এই
বইতে।
‘নীল বিড়াল’-এর কবিতাগুলোতে একটা তীব্র উদাসীন বিষাদ, অতৃপ্তি; যেন বা আলোহীন অবসন্নতা বলা
যায় তাকে, বিনির্মাণের মুখোমুখি তার নিরন্তর লড়াই, বেদান্তবাদ এবং
বৌদ্ধভাবনা-কেন্দ্রিক অলীক সন্তুষ্টির খোঁজ। তাঁর ‘কালো বিড়াল’ কবিতাটির দুটি
পংক্তি এরকমঃ ‘তাদের তীক্ষ্ণ লেজের ডগায় ঝুলে আছে/ আধখানা ধোঁয়াটে চাঁদ’;
এদিকে মনা বেড়াল-৩-এ দেবাঞ্জন লিখছেন, ‘মনে হয় বালিতে তালিম নিতে শীৎকার
এসেছে/ আর হাঁটার মানে বদলে দিচ্ছে চন্দ্রহার’। এক অমোঘ উদাসীনতা টের পাই।
শিরশির বয়ে যায় মেরুদন্ডের হাওয়া। যেন যুদ্ধের শতক সপাটে পেরিয়ে এসেও চাঁদের আঘাতে
থাবা পেতে বসে আছে গোপন বেড়াল, মুখ উঁচু করে শুষে নিচ্ছে অপেক্ষার হাভানা গন্ধ।
সাকুতারো পরে বলেছিলেন যে
বিড়াল সংক্রান্ত তাঁর এই সমস্ত কবিতাগুলো জীবনের সেই সময় নিয়ে লেখা যা তাঁকে অশেষ
নৈরাশ্যের মধ্যেও লিখতে প্রেরণা যুগিয়েছিল কিন্তু ভবিষ্যতের প্রেক্ষিতে তাকে আর
নিখুঁত মনে হয় না। কবিসুলভ এই দ্বন্দ্ব একান্তভাবেই তাঁর নিজের এবং কবিতার পাঠবদলের
প্রেক্ষিতে তা বিচার্য নয়, কেননা তা সময়কে অতিক্রম করতে পেরেছে। দেবাঞ্জনের ‘মনা
বেড়াল’ সিরিজ পড়েও আমার একই অনুভূতি। ব্যক্তিগত আকাঙ্খা ও স্বপ্নের অনিবার্য দলিল
তার এই কবিতাগুচ্ছ, লঘু চপল পায়ে সময়কে অতিক্রম করে যাবে কিনা তা সময়ই বলবে। পাঠকের
ভালবাসা তারা এখনই পেয়ে গেছে। পেয়েছেন তিনিও, ‘কলিমে ফুটবেন বলে’ বসে ছিলেন যে মনা
বেড়ালটি।
‘মনা বেড়াল’ সিরিজ শেষ
হতেই কবিতাগুলো অন্যরকম। বেপরোয়া একটা বাঁকবদল। হালকা মাতিয়ে দেয়ার উঠোন হয়ে উঠছে
ধীরে ধীরে বাকি বইটার পলাশ। রূপকথার ফাগুন ঢালছে ‘রংবদর চরৈবেতি’। কিছু কিছু
প্রয়োগ একটু পুরোনো লাগে এই মঞ্জিলের লেখাগুলোতে। যেমন, ‘আকাশের শামিয়ানা’,
‘তিতলি’, ‘চেনা সব বুনোলতা’, ‘বিকেল খুঁজছে আলো’, ‘টাঙিয়ে রাখি পলাশে’, তবে গুস্তাখি-তে
এসে আবহটা পালটে যায়।
কি বা পার্থক্য বল কবিতা আর
কমলালেবুর পেকে ওঠায়
লেবুতে ঘাম জমলে চাষবাস ফেলে ঘরে
ফেরা
একেবারে স্ট্রেট ব্যাটে খেলে দেয়া বাউন্সার!
অসামান্য! এবং বঙ্গভঙ্গ –
বুঝি না কাটা গুঁড়ির গন্ধ নেবে
বলে
মানুষ কেন অল্প ঝুঁকে ট্যুরিস্ট
হয়ে যায়
তোমাকে লেখা কবিতাগুচ্ছে বৃষ্টির নিপুণ প্রাবল্য দেখি। ৫ নম্বর কবিতা—
ওরে সুদূর ফলসা গাছ
সাগরপাড়ের আমজাদিয়া
এমন করে কেউ ডেকেছে তোমায়?
ন্যাতানো প্রেমের কবিতার চোরাবালিতে পা ফেলতে
অভ্যস্ত বাঙালি পাঠকের জন্য এইসব পংক্তি নশিলি মেঘের ফুরফুরেডাঙা।
তোমাকে লেখা-র ৭, ৮, ১০ নম্বর কবিতায় আনোখা পাগলামি আছে। তারা জানে, বনের কাছে এলেই যারা
উপোসি সারেং হয়ে যায়, মুসাফির হয়। ভেঙে ফ্যালে বানে ডুবতে থাকা নদীর সংসার—
ধীরে আকাশ হিম হল
কি হল তার পাখিসাট জানি না
শুধু গভীরে
বনকে বড় বৌ বলা হয় চুপি চুপি...
তোমাকে
লেখা-৭
এই কবিই অচেনা যখন সে লিখছে—
ধান কাটার আখ্যানে সন্ধ্যাপ্রদীপ
রাখবই
মা
মেয়ে
মাগ
বেশ হবে পারিবারিক পানের ডিবে
তোমাকে লেখা-১০
কবি অচেনা হয় এবং হয় বলেই তাকে পড়া। তার
পংক্তিগুলোকে বারবার পাঠ করতে চাওয়া। কবির কোনো পূর্বনির্দিষ্ট পথ নেই বলেই পাঠকের
সে পথে হাঁটতে চাওয়া। এখানেই তো অচেনা সার্থক। ‘সোলো থামিয়ে দেখি একই চৌপথী
বারবার’। এভাবে পংক্তি না তুলে দিয়ে বলতে চাইছিলাম, কিন্তু আমার সাথে আপনাকেও
পড়ানোর লোভটা, পাঠক, সামলানো যাচ্ছে না। এক ধুলোকাদাময় শিশু সংসার তৈরি করা,
বিছানার আবডাল থেকে ‘গাছপালার চশমা’য় নিয়ে আসা; এবং তারপরে তাকে পাকিয়ে কষিয়ে
বাড়তি মেদ ঝরিয়ে সেই সংসারের চালচুলোর ফাঁকে জমে ওঠা কালো কালিতে আঙুল ঘষে ঘষে
কাজল তৈরির চেষ্টা— ঠোঁটের কোণে এক মুসকুরাহট নিয়ে— ‘মুমফলি রোদ’-এর এই জীবনদর্শন,
‘খামোশ স্নায়ুর শিল্প’— একজন কবিই শিখিয়ে দিতে পারেন আমজনতাকে।
স্প্রিং খাট কবিতাগুচ্ছ এক নতুন বন্দীশ আমার কাছে। দেবাঞ্জনের চেনা ঔদ্ধত্য, অবজ্ঞার খাঁচা
থেকে এক অভিনব কবি বের হয়ে আসে, দেবাঞ্জন যার পিছু পিছু হেঁটে যায়। ‘গ্রামবাসীরা
মানতেই চায় না/ আমি খেয়াল করিনি বলে আজ জ্যোৎস্না হয়নি’— বলতে বলতে খেজুর
গাছের নিচে মোটা চশমা খুলে রাখে, এবং তৎসত্ত্বেও দেখতে পায় স্পষ্ট। শাণিত অধিকারবোধ
ঝলকে ওঠে, কার যেন সেই বেদন ধার করে কবি বলে— ‘আর আমি জেগে বসে আছি ওরা আসবে
বলে/ আজ স্মৃতিতে ডিম পাড়া হবে’ । এভাবে নির্জনে নিজের ভিজে যাওয়াকে
স্যাঁতসেঁতে বলে দেয়ার ক্ষমতা সম্প্রতি চোখে পড়েনি।
‘হালুম’ শব্দের প্রয়োগ ভাল লাগেনি আমার— তোমার
মন গেল অদৃশ্য হালুমে (স্প্রিং খাট ৫)। ‘টোল’ শব্দের প্রতিও কবির ব্যবহার খুব
সূক্ষ্ম নয় মনে হয়েছে— টোল পড়ে গেলে যেকোনো কালকে আগামীকাল ভাবি (স্প্রিং
খাট ৪) এবং আগে একবার— ঘুম ভাঙার পর টোল পড়ে ঝাউবনে (মনা বেড়াল-৩)। এড়িয়ে
যেতে নয়, শান দিয়ে ধার বাড়িয়ে তুলুন— এই দাবি। তবে দাবি তো পাঠকের, এবং পাঠকের
ভিন্নতায় তা বদলে যাবে, সুতরাং টোলে নেশা লাগবে নাকি টোলের আদল ভেঙে ঈশ্বর হাততালি
দিয়ে উঠবেন আমুদে বায়নায়, তা কবিরই
সিদ্ধান্ত। এই সিরিজের কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে মনে হয়েছে জলজঙ্গল
রঙকার্ণিশ বেয়ে এঁকেবেঁকে পথ করে নেয়ার কবির যে স্বতস্ফূর্ত ক্ষমতা, তা বহুগুণ
বেড়ে গেছে। পুরো বইটা জুড়ে যৌনতা এসেছে বারংবার। খুব সাহসী সেসব মর্মর অথচ নগ্নতার
আধিক্য নেই। শুধু ‘মাংস আর জল’-এর তীব্র উচ্চারণ। ভাঁটুফুলের সুঘ্রাণ, মেঘ কেটে
আদিম বিছানায় চাঁদের ফুটে ওঠা।
অপেরা
সিরিজ কিছু বলার দাবি রাখেনি পাঠকের কাছে। সে এক উন্মুক্ত হাসির অরণ্য। হাঁটতে
গেলেই খিলখিল পাতা ঝরে যায়। বিস্ময়স্তব্ধ এক চেয়ে থাকা, আঙুলের অল্প স্পর্শ, নিবিড়
চোখের জল— শুধু এইটুকু অপেক্ষা পরিচয় খসিয়ে বড় হয়ে ওঠে, অপর এক ভবিষ্যের ভেতর— উঠে
গেলে গমগম করে/ অনির্বচনীয় উত্তরাধিকার।
পরের বইয়ের অপেক্ষায়, শুভেচ্ছার হাল্লাবোল।
0 comments:
Post a Comment