Friday, March 11, 2016
সোনালী চক্রবর্তী
বাঙলা
সাহিত্যের 'ব্যতিক্রমের ব্যতিক্রম' প্রবাদ পুরুষের প্রায় অপরিচিত উপন্যাস "শ্যাম-
নৌকা"তার
স্রষ্টার মতোই নিগুরহ তত্ত্ব সমন্বিত আপাত জটিল অথচ সূত্রানুসারে অতি সরল স্বয়ং এক
বিচিত্র তথাপি
পূর্ণাঙ্গ experiment । কমলকুমারের পাঠক মাত্রেই জানেন তাঁর গভীর আধ্যাত্মিক
অনুধ্যায়নপ্রগাঢ়
পাণ্ডিত্য, সময়ের তুলনায় কয়েক সহস্র যোজন এগিয়ে থাকা উত্তর আধুনিকতা, সর্বোপরি একান্তই
নিজস্ব গদ্যশৈলীর কথা যাকে গদ্যসাহিত্য বলায় এই আলোচকের তীব্র আপত্তি রয়েছে। কমলকুমার
কবি। কবিত্ব শুধুমাত্র তাঁর সত্ত্বায় নয়, তাঁর জীবনব্যাপী সাহিত্য কর্মের মধ্যেই
নিহিত । কিন্তু
ইঙ্গিত মাধ্যমের উপর অধিকাংশ স্তরে নির্ভরশীল হওয়ায় তার লেখনীকে কোন পাঠকই
অদ্যাবধি নির্দিষ্ট
কোন genre এর আওতায় -এমত দেগে দিতে পারেন নি। এ তাঁরই সাফল্য।
"তুমি
দীনবন্ধু" এই বাক্যবন্ধ "শ্যাম- নৌকা" র প্রারম্ভিক চয়ন যা সমগ্র
উপন্যাসটির মূলাধার । প্রবল নাস্তিক
মনন নিয়ে কমলকুমার পড়তে আসাকে অনেকে তার ভাবের বিরুদ্ধাচারন বললেও আদতে এই
কথার বাস্তবতা নেই কারন কমলকুমারের শ্যাম কোন মূর্তি, প্রথা, প্রকরণ তথা পূজার
বলয়ে সীমাবদ্ধ
icon মোটেই নন, এই শ্যাম এক অতীন্দ্রিয় অনুভবের প্রকাশ মাধ্যম। তা পার্থিব
প্রকৃতির রঙে,
বস্তুতে লীন। বাউল, সুফি ,শৈব, শক্তি ইত্যাকার সাধন মার্গের সঙ্গে আপাত সম্পর্ক
বিরহিত এই
সাধনা একান্তভাবেই তার স্বতঃসৃষ্টি । উপন্যাসের নায়ক কালাচাঁদ কিশোর, মহিষচারী ।
তার কৃষ্ণ গাত্রবর্ণ,
ললিত গড়ন, রমণী প্রিয়তা আভাসেও বৃন্দাবনবাসী ঘনশ্যামের কথা জানতে দেয়না শুধুমাত্র তার
সৃষ্টিকর্তার প্রেক্ষাপট, চরিত্র ও ঘটনার বিন্যাস বুননের ব্যাখ্যাতিত ক্ষমতার
কারনে। সেখানে "কুয়াশায়
হাবা সোহাগহীন", "নিঃসঙ্গতা যাহার মধুজাদু", সত্যই "যাহার হাব
ভাব বুঝা অঙ্কে আসেনা"
সেই
সুদূর অতীতে বসে কমলকুমার কি অনায়াসে নির্মাণ করেছেন রূপান্তরকামী চরিত্র মা- রসকে
তথা রসিক
মণ্ডল কে। ঢপের দলের তথাকথিত অশ্লীল খেউর এর ফাঁকে যার সঙ্গীত সাধনে বিলাসখানি
তোড়ি ওস্তাদ
সুলভ কারিগরিতে একীভূত। যে 'এতল-বেতল' ও খেলে আবার "মেয়েলি সুলভ
কেয়ারীতে" বনবিবির
পূজার যোগারও সারে।
"শ্যাম-
নৌকা" পড়বার জন্য যদি কোন specific প্রস্তুতির উল্লেখ করতে হয় তবে তা হল
একমাত্র sensitivity
তে শান দিয়ে নেওয়া। কমলকুমার এই উপন্যাসে শুধুমাত্র মূল চরিত্রকে কালাচাঁদ নাম
দিয়ে আর
তার জীবন ধারাকে গঙ্গাবক্ষে নিমজ্জিত করে motif ভিত্তিক নামকরন করেননি, তার ভাষার ব্যাবহার
বৈষ্ণবরসে সিক্ত, দৃশ্যকল্প "গম্ভীর, শ্যাম " , ঘটনার ব্যাখ্যানে
কীর্তনাঙ্গের সুর,কথন প্রেমিক সম
আবেগমথিত,গদ্যের চলন প্রায় ইশারা ভিত্তিক পদাবলী। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে জাগ্রত না করলে
চম্পূটির মূল
বিষয় (যা সর্বচ্চ পাঁচ লাইন) কে বোধগম্য করা প্রায় অবাস্তব।
ভাবতে
বিস্ময় বোধ হয় কি উপায়ে কমল্কুমার পারলেন "শ্যাম- নৌকা"- য় দাঁতে কুটো
চাপার বৈষ্ণবীয় দীনতার
ব্যাখ্যানের সঙ্গে "কুত্তামজান" , "হিজড়ে- উচিত" , "ফজলী
গতর" ইত্যাকার শব্দ ব্যাবহারকে আশ্চর্য
স্বাভাবিক করে তুলতে। আড়কাঠি, চোরা পাচারকারী দু- কড়ি তার সমস্ত কদর্যতা নিয়েও সেখানে
'অচিন গাছ', 'প্রাচীন একটি বীজ'।
মারন
ব্যাধিতে আক্রান্ত পিতাকে তার সমস্ত অত্যাচারের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন পূর্বক
প্রায় সন্তান স্নেহে
বালক কালাচাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা বিদ্যুৎ ঝলকের মতো অতি
ক্ষণস্থায়ী কিন্তু
সুতীব্র আলোকপাত করে এই journey এর উপর । এ কি archytypal শ্যামের পচনউন্মুখ
কুরুবংশকে রক্ষার নিমিত্ত কুরুক্ষেত্রের আগের শেষ সন্ধিপ্রস্তাব নয়?
অজস্র
কানুভাবের গানও এত সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়না "শ্যাম- নৌকায়" যেভাবে
কালাচাঁদের 'নো ব্লাডি পাপ' প্রকট উক্তিটি শ্রীহরির শ্রীকৃষ্ণ অবতারে যাবতীয়
কুট নীতি , রাজনীতির চালের alleby হিসাবে দুর্ভেদ্য
শস্ত্র নির্মাণ করে ।
আশ্চর্য
কোমল, পরমাশ্চর্য মায়াঘন পিতা-পুত্রের শেষ কথোপকথন যেখানে প্রসব বেদনাকালে ধনুষ্টঙ্কারে
মৃতা মায়ের প্রসঙ্গের অবতারনা হয় 'ঠিক যেন ড্যাংগার মাছ' এই রূপকে। নিশিন্দের
ডালকে মলমে
গুঁজে যেখানে ছায়া সঞ্চার করা হয় কদম বৃক্ষের না গিরি গোবর্ধনের substitution এ,
সে রহস্য কমল্কুমার
ব্যাতিত উদঘাটন সোনার পাথরবাটি। সর্বস্ব পণ করে খেলতে নেমে মেলার জুয়াতে অন্যায়
ভাবে
ঠকে যাওয়া আর তার পরবর্তীতে বাজির অধিকার ও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ব্যাঙ্গের মত
কুরুসভার পাশাখেলাকে
মনে করায় অথচ সেখানে পাঞ্চালী চরিত্রের ন্যায় কোন dramatic parallel কে না তৈরি করায়
কমলকুমার থেকে যান স্বতন্ত্র , নিজস্ব নির্মাণে একান্তভাবেই 'আব্রহ্ম ত্রিভুবন'।
বাবার
মৃত্যুশোকে আছন্ন কিশোরের মাধব উচ্চারণে সমর্পণ সাধক জীবনচক্রের মোহ থেকে কুলকুণ্ডলিনী
জাগ্রত করতঃ মহাসমাধিতে উত্তীর্ণ হওয়াতেই প্রতিবিম্ব দর্শন করায়। প্রতিটি তন্ত্রী
একই সুর
তোলে যেখানে সমগ্র অস্তিত্ব দীনহীন হয়ে সেই পরমাশক্তির শরণাপন্ন হয়, বড় অসহায় হয়ে
পড়ে বোধ
, বড় ভোঁতা হয়ে যায় শিক্ষার অহংকার । কমল্কুমার পরমানন্দে দুর্জ্ঞেয় স্রোতে তার
"শ্যাম-
নৌকা"
ভাসান আর তার উপন্যাসের তাৎক্ষণিক পাঠ- প্রতিক্রিয়া দিতে বসে এই অক্ষম আলোচক কেঁদে
বলে ওঠে ......
"আমি আসবোই , ভালোবাসা দিও -
দেখ আমার ভালোবাসা ধোবা ঘরে যাবেনা"
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
অনেক আগে একবার পড়েছিলাম। বলতে দ্বিধা নেই ততটা বুঝিনি তখন যতটা পরিব্যাপ্ত। অদ্ভূত বিশ্লেষণ করেছেন লেখিকা। চোখের সামনে সম্পূর্ণ অবয়ব এভাবে উচ্চারিত লেখিকা সোনালীর কলমে যেন খোলা ছাড়ানো পৃথিবীর দায়বদ্ধতা। সাধুবাদ দিচ্ছি না এতটাই নগণ্য। কমলকুমার বেঁচে আছেন। আপনিও থাকলেন।
ReplyDeleteঅজস্র ধন্যবাদ
Delete