Friday, March 11, 2016
এ মাসের কবি – মার্চ ২০১৬ – বিজয় দে
এ মাসের
কবি বিজয় দে। তাঁর জন্ম ১৯৫১ সালের ১লা জানুয়ারী। স্থান জলপাইগুড়ি, নতুনপাড়া। লেখালেখি ১৯৭৫ সাল থেকে।
সম্পাদিত পত্রিকা পাগলাঘোড়া, কবিতা জংশন। ১৯৮৫
সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতার প্রথম বই, ‘হে থুতু হে
ডাকটিকিট হে অরণ্য’। পরের বই
১৯৯৪ সালে, নাম ‘কাঠুরিয়া আন্তর্জাতিক’। তারপর ‘বম্বে টকি’ ২০০০ সালে।
দীর্ঘদিন বিরতির পর আসে ‘জঙ্গলসূত্র’, ২০১৫
সালে। আর, সুখের কথা, এই বছর , অর্থাৎ ২০১৬-তে ‘এখন’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দুটি বই --- ‘কামরাঙা এবং ট্রামলাইন’ আর ‘বাবলিবাগান’। প্রসঙ্গতঃ, ‘বাবলিবাগান’ সিরিজের কবিতার শিরোনামে ব্যবহৃত উদ্ধৃতিগুলি তাঁর প্রিয় কবি জীবনানন্দ
দাশের গল্প-উপন্যাস থেকে গৃহীত...
এখানে
উল্লেখ থাক, কবির প্রিয় খাবার ভাত/রুটি/মুসুরির ডাল, লংকা পোড়া দিয়ে মাখা জাম্বো
সাইজের আলুসেদ্ধ... তাঁর কবিতায় মিলেমিশে যায় ক্ষীরের দলা, ঘাম ও জ্বরের কথা, ভাষা
ও কুয়াশা, উলুধ্বনি, শীতকাল...
আমরা
তাঁর কবিতার ভেতর চলে যাই আস্তে আস্তে...
বিজয় দে-র কবিতা
রঙের নাম
রঙের নাম আমার বাড়ি। আমি কি
রঙের স্বেচ্ছাচারী?
এই শহর তোমার আসল নগ্নতা; যেন বহমান রাসলীলার ধূসর বাসমতী;
হলুদ কালিতে ছাপা সবুজ পাঠাগার, শহরে
সমস্ত পুস্তকের অর্থ মূলতঃ তোমার শরীরের নিমন্ত্রণ
আমি একসময় তোমার ভোরবেলা অবধি ছুঁয়ে ফেলে ভেবেছিলাম
কোনও রঙের কোম্পানী ছুটে আসবে। আসেনি। হয়তো
কোনও দিন আসবে না
মনে পড়ছে, হা হা করতে করতে একদিন একটি বন্ধ খামারবাড়ি
বাদামী রঙ হয়ে দৌড়ে এসেছিলো;
আজ মধ্যরাত থেকে একটি নতুন রঙের কোম্পানী খুলে দিলাম। রঙের নাম
তোমার বাড়ি; এই শহরের প্রহরজোড়া খাকি রঙ
তোমার নগ্নতা যেন ঘুমন্ত পুলিশফাঁড়ি
পেঁয়াজ
হে কবি, বাজারে যাও, আজ কিছু পিঁয়াজ আনিও। লংকা আনিও
নুঙ্কু নয়, নংকা নংকা... নেবুও আনিও
নুকিয়ে নুকিয়ে নুচি খাচ্চো তুমি! এত নেকু নেকু কেন
হ্যাঁ’গা, আজ কি তোমাদের নবকুমারের
জন্মদিন?
চাঁদে যত দন্ত্য-ন আছে, সবাই কথাগুলো গিলছিল
এবার একসঙ্গে দাঁতের সব হসন্ত বা’র করে
হো হো হো হা হা হা
হেসে
উঠলো
পিঁয়াজের চোখে জল; পেঁয়াজের চক্ষে জল
আঁখো মে পানি
আহা, পেঁয়াজ, জানি জানি বাজারের সব জানি, তুমি কেঁদো না
আহারে, পেঁয়াজের জীবনে কোনও ন নেই
মোজা
বাড়ি বানানো খুব মজার; ওপরে আকাশ নিচে বাজার
হ্যাঁ, এটুকু সবাই জানে
হতে পারে বাজারও আজকাল ওপরে উঠছে; আকাশের চাতালে গিয়ে বসছে,
কখনওবা আকাশ একটু সময় পেলে উঁকি দিচ্ছে, বাজারের ভেতরে; তবু
অগড় ডগড় ঘি মুড়ি ঝুড়ি ঝুড়ি মাটি আনো কাঠি আনো
এড়ি দোড়ি তেলোয়া চৌরি খেলতে খেলতে
সাত গেরামের দুধের সর আনতে আনতে
আট কুটুমের গলার স্বর শুনতে শুনতে
নয় হাটুরের নজর টানতে টানতে
দশ পুরুষের পাঁজর আনো বলতে বলতে
একটি দু’টি জ্বর আনো লিখতে লিখতে
বৌভাতের পর’ ভাজা মৌরী খেতে
খেতে
মনে হবে ‘আরে বাড়ি তৈরী তো খুব সোজা’
ওপরে টুপি নিচে মোজা; যদিও মোজার ভেতরে সারাদিন
আমাদের কিছু কিছু গোঁজামিল বেঁচে থাকে
মোজায় একটু দুর্গন্ধ না থাকলে বাড়ি তৈরির আর মজা কোথায়
ক্কোয়াশ্ ক্কোয়াশ্
ক্কোয়াশ্ ক্কোয়াশ্; ক্কোয়াশ্ ক্কোয়াশ্
একটা পাখি ক্কোয়াশ্
ক্কোয়াশ্;
কেবলই
ডেকে যাচ্ছে...
এবং এই ডাক এই প্রথম; আমি শুনলাম
সে একটি শক্ত ও সমর্থ পাখি
এরকম পাখি তো হয়ই, কিন্তু এরকম ক্কোয়াশ্ ক্কোয়াশ্
না, আমি আগে কখনও শুনিনি
অথচ পাখিটিকে দেখে গেছি দিনের পর’ দিন
পাখিটি কি গতকালও বোবা ছিল?
শুনেছি, এই পাখি নাকি এখানে জলের খবর রাখে
শোনা যাচ্ছে, চাঁদের পেটের ভেতরে এই পাখি যদি দশ মাস
দশ দিন ক্রমাগত ডেকে যায়
তখন কবিতায় জল নিয়ে কোনও সমস্যা হয়না
হঠাৎ গীতা ঘটকের গান
‘রক্ত দিয়ে ছাপানো একটি চিত্রনাট্য’
এছাড়া এখানে এসে তোমাকে আর কিইবা বলা যায়
‘মহাশূন্যে একজন গর্ভবতী মায়ের পেট’
আমরা বললাম ‘শূন্যে যা-খুশি
হোক
গীতা ঘটকের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত ভেসে না এলে
আমরা কিন্তু প্রসূতিকে ছুঁয়েও দেখবোনা’
এবার শূন্যের ভেতরে একটি দৃশ্য প্রবেশ করলো এবং শূন্য থেকে
একটি দৃশ্য প্রস্থান করলো
শব্দ এসে মাঝে মাঝে এই দৃশ্য সেই দৃশ্য
সকল দৃশ্যের গাল টিপে দিল
গান শুনতে শুনতে
মহাশূন্যে সংলাপ লেখা হোলো; চাঁদ খাও মা
দু’বেলা পেট ভরে চাঁদ খাও
তারপর হাততালি প্রসব করো
হারিকেনের একদিন
ভুলে গিয়েছিলাম। তাই
অনেক অনেক দেরী হয়ে গেলো। রাতদুপুরে
হারিকেন জ্বালাতে গিয়ে একেবারে মায়ের মুখোমুখি; এবং প্রবল
ধমক
‘তোদের কি সময়-গময় নাই? যেটা সন্ধেবেলার কাজ,
সেটা এত রাত্তিরে?
এরপর’ কখন আলো জ্বালাবি, কখন বা
মালা পরাবি, কখন যে বিয়ে হবে?’
বিয়ে! আমার চক্ষুগাছ চড়ক! উলটো ধমক দিয়ে মাকে বললাম ‘চুপ করে
শুয়ে থাকো তো, সব ব্যাপারে মাথা ঘামাতে ঘামাতে তোমার মাথায়
এখন বিয়ে চাপছে’...
মা শুয়ে পড়লো।
আমি চিমনি মুছে আলো জ্বালালাম। তারপর’ হারিকেনের গলায়
একটা গাঁদাফুলের মালা পরিয়ে দিলাম। সবাই জানে, মালা পরালে
আলো খুব খুশি হয়
তারপর’ আমিও শুয়ে পড়লাম
পরদিন, ঘুম থেকে উঠে দেখি, হারিকেনের গলার মালাটি
মায়ের গলায়; মায়ের চোখে-মুখে মিটিমিটি কান্না
আর হারিকেনটি দাঁত বা’র করে হাসছে
ফলক
“আমার শাসনকালে ঘামরোগে সকল হৃদয়বাসনা ও
বসবাস নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো
কিন্তু আমি যথাসময়ে কোনও নতুন শরীর পাততে পারিনি
আমার শাসনকালে সতেরোবার আমার শয়নঘরের ভেতরে
সাত-দু গুণে চোদ্দ পাড়ার যত দাঁড়াশ সাপ
পেট-ভর্তি ব্যাঙের ডাক নিয়ে বেড়াতে এসেছিলো
মনে আছে আমার শাসনকালে রান্নাঘরের ভেতরে
খোলা-চুল ফুস্-মন্তর; চুল-খোলা ফুস্-মন্তর
চুল-ছেঁড়া ফুস্-মন্তর; চুল-পোড়া ফুস্-মন্তর
এবং
মন্ত্রের ভেতরে পাকাচুল ফুস্-মন্তর করেছিলো
আমার শাসনকালে চোখে চোখে মৃতকবিদের কিছু সাক্ষাৎকার হয়
তার সঠিক দৃশ্য আছে কিন্তু কথা অদৃশ্য; এবং
দুপুরবেলা সেই সব বাক্যের বিষণ্ণ ছায়ারা
শহরের পথে পথে হেঁটে গিয়েছিলো”
মৃত্যুকালে এই শাসনকর্তা বালিশের নিচে কিছু অস্পষ্ট হাতের
রেখা
রেখে গিয়েছিলেন।
কবির লেজ
পৃথিবীতে যখন কোথাও কোনও ডানা ছিল না
তখন কথা নেই বার্তা নেই
পৃথিবীতে প্রথম তেজপাতা এলো
সেই তেজপাতা যখন পৃথিবীতে পালকের মতো মেঘের মতো
মনের মতো, মনে মনে ভেসে বেড়াতে শিখলো
তখন কিভাবে কিভাবে যেন একজন কবির
লেজ গজালো
এই লেজ দিয়ে কবি ইস্তাহার লিখলো
স্বপ্নকে স্পর্শ করলো
কবিতাকে আদর করলো
কিন্তু কবি পৃথিবীর কোথাও এখনও আগুন লাগাতে পারেনি
এই লেজে এখনও তেজপাতার মুখচোরা গন্ধ; আর
ঈশ্বর তখন থেকে এই লেজ দেখাশোনা করে যাচ্ছেন
চাঁদপুর
চাঁদের চোরা আলো চিবোতে চিবোতে মুখের পূর্বপাড়া
যত অস্ত যেন এখানেই
হে প্রতিদিন নতুন নতুন দারিদ্রসীমারেখা
তোমার ছায়ার নিচে থুতু একটি দুঃখ-শেখার স্কুল খুলেছে
তখনও ঘন্টা বাজেনি; অথচ একবার আমাকে ফেলে রেখে
থুতু উধাও
চাঁদপুর পেরিয়ে কোথায় না কোথায় চলে গিয়েছিলো
এই চাঁদপুর আমার জন্য কোনওকালে অপেক্ষা করেনি
থুতুও আমাকে পৌঁছসংবাদ দেয়নি
দুঃখ-শেখার স্কুলে থুতুর কেবলই ভুল হয় ভুল হয় ভুল হয়
দীপ্তি ১১ হাত
যে-সমাজে দীপ্তি আছে সেখানে সবার একবার ঢোকা উচিৎ। দু’বেলা দাঁত মাজো
তারপর আয়নার দিকে তাকিয়ে হ্যা হ্যা করে হাসো;
দীপ্তি মানে পুরোন দিনের ফুর্ফুরে প্রেম; যে কিনা শাড়ির
নিচে কোনওদিন মশারি পরেনি
এবার সামাজিক ভাষা; হরিণের ভেতরে যদি ইলিশমাছ লাফায়,
গায়ে-হলুদের ভেতরে
যদি সাহেব-মেম লালপতাকা সঙ্গে নিয়ে ঢোকে, তখন পার্লামেন্টে
শেম্ শেম্ ধ্বনি ওঠে
কেননা ভাষার তো কোনও কিছুরই সঠিক হদিশ পাওয়া মুশকিল
যে-রকম বাংলা; শীতকালে বাজারে প্রচুর পালং, অনেক কালিঙপং
কিন্তু কোনটা যে কোথায় থাকে কে জানে
ভাষাকে এরকম খেলাধূলা করতে দিয়ে আমরা সবাই
অ্যাকাডেমিতে চা খেতে গিয়েছিলাম
ফিরে এসে আলাপ শুনছি; যে-সমাজে দীপ্তি এখনও দপদপ করছে
সেখানে ভাষাকে শাড়ি; শাড়ির নিচে মশারি;
মশারির ভেতরে এগারো হাত হয়ে কে শুয়ে আছে, কে?
ছোট গল্প
ঘণ্টি বেজে গেছে, অথচ তখনও জয়শীলার কবিতা সডাক এসে পৌঁছোয়নি।
-
‘ইয়ে জয়শীলা কৌন হ্যাঁয় ভাই? জানেয়ালি?’
-
‘নেহি তো ক্যা আনেয়ালি?’
-
‘কখন আসবে বা ছাড়বে জানা আছে কিছু, ভাইয়া?’
-
‘বহেনজি, জয়শীলাকা টাইম ঠিকঠাক্ চল্ রহা
হ্যাঁয় ক্যা?’
-
একটা গোটা জঙ্গলকে যদি দুনিয়ার সব
থেকে বড় নৌকো
বানানো যায় তাহলে সেই
নৌকায় চড়ে,
ভাইসাব, জলপাইঘাট পৌঁছনেমে
কিত্না টাইম লাগেগা?
প্রশ্ন শেষ হয় এরকম
অন্যরকম ; আর শুনতে শুনতে
ঘাটশিলা স্টেশনটা দু’ভাগ হয়ে যায়
একদিকে নিউ লতাপাতা-সঙ্ঘ টাইম-টেবিলের পাতায় ঢুকে
সময় ছিঁড়ে ছিঁড়ে
মইষাল
গানের সুর বসাচ্ছে
অন্যদিকে ৮ নম্বর গানের খাতা স্টেশন মাস্টারের পোষা বটগাছের
গোড়ায়
সুবর্ণরেখার জল দিচ্ছে
আমাদের কি সৌভাগ্য, ঠিক সেই সময় জয়শীলার কবিতা
ঘাটশিলা স্টেশনে পৌঁছে যায়
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
eito sei choto golpo ta.... durdanto priyo sei choto golpo ta...
ReplyDeletear gita ghatak ta to anoboddo...
tobe kobitagulo bijay dar mukhe sunte aro oshadharon lage...
অনবদ্য প্রত্যেকটাই। ফলক, ক্কোয়াশ ক্কোয়াশ, কবির লেজ, গীতা ঘটকের গান, হ্যারিকেন, চাঁদপুর কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি!
ReplyDeleteExcellent !
ReplyDelete"চাঁদ খাও মা...দু'বেলা পেট ভরে চাঁদ খাও...তারপর হাততালি প্রসব কর"
ReplyDeleteস্তব্ধ...
bhalo laglo
ReplyDelete